দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গে ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে এমনকি সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছিল। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের তরফ থেকে সমস্ত ওবিসি সংরক্ষণ কে সুযোগ করে দিলেও পশ্চিমবঙ্গের সংরক্ষণ নীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনল কলকাতা হাইকোর্ট। কলকাতা হাই কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায় দিলো যেখানে ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে আবারও তোলপাড় শুরু হবে রাজ্যে। ইতিমধ্যে বিচারপতি কৌশিক চন্দের বেঞ্চের এই রায় শুধু শিক্ষা ও চাকরি নয়, অন্যান্য ক্ষেত্র বিশেষ করে রাজ্যের সামাজিক কাঠামোতেও গভীর প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কলকাতা হাইকোর্টের তরফে যে রায় দেওয়া হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, রাজ্যে শুধুমাত্র ২০০৯ সালের ওবিসি তালিকা অনুযায়ী সংরক্ষণ কার্যকর হবে বাকি যে সাম্প্রদায়িক গুলোকে যুক্ত করা হয়েছিল সেগুলো বাদ পড়বে। অর্থাৎ এই সিদ্ধান্তের ফলে রাজ্যের প্রায় ৭৪টি সম্প্রদায় আপাতত সংরক্ষণের সুবিধা থেকে বাদ পড়তে পারে। অর্থাৎ নতুন করে যুক্ত হওয়া এই ৭৪ টি সম্প্রদায় আপাতত কোন চাকরির ক্ষেত্রে বা কোন ভর্তির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের সুবিধা পাবেন না।

ওবিসি সংরক্ষণের বিবর্তন

কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রথম ওবিসি (Other Backward Classes) সংরক্ষণ চালু হয় ১৯৯৩ সালে। এরপর আবার নতুন করে তবে ২০০৯ সালে তৎকালীন সরকার একটি তালিকা প্রকাশ করে, যেখানে মোট ৬৬টি সম্প্রদায়কে ওবিসি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং ৭% সংরক্ষণ নির্ধারণ করা হয়। সরকারি চাকরি এবং অন্যান্য সমস্ত ভর্তি এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এই নিয়ম বহাল ছিল।

পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এটি পরিবর্তন করে এবং ২০১০–২০১২ সালের মধ্যে নতুন সরকার আরও সম্প্রদায় যুক্ত করে, এবং ওবিসি ক্যাটাগরিকে দুটো ভাগ করে ওবিসি-এ এবং ওবিসি-বি বিভাগ তৈরি করে যেখানে সর্বমোট ১৪০টি সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। অবশেষে দীর্ঘদিন ধরে এই সম্প্রসারণ নিয়েই বিতর্ক চলছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এই বিতর্কের অবসান ঘটলেও হাইকোর্টের নির্দেশে আবারো নতুন করে শুরু হলো বিতর্ক।

নতুন ওবিসি তালিকা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত

২০১০ সালের নতুন করে যে ওবিসি সম্প্রদায় ভুক্ত জাতি যুক্ত করা হয়েছিল সেখানে বিরোধী দল এবং কিছু সামাজিক সংগঠন অভিযোগ করে যে, নতুন তালিকা তৈরি করার সময় পর্যাপ্ত সমীক্ষা হয়নি এবং কিছু সম্প্রদায় রাজনৈতিক কারণে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর ফলে প্রকৃত যারা সংরক্ষণ পাওয়ার যোগ্য তারা সংরক্ষণ থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। এর ফলে পুরনো তালিকায় যারা যুক্ত ছিল এবং যারা সংরক্ষণ পাওয়ার যোগ্য তারা সংরক্ষণ থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত হচ্ছে এবং নতুন করে যাদের যুক্ত করা হয়েছে তারাই সর্বাপেক্ষা অধিক সুবিধা পাচ্ছে।

কলকাতা হাইকোর্টের রায় কী বলা হয়েছে?

ইতিমধ্যের রাজ্যে বিভিন্ন কলেজগুলোতে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে কিন্তু জয়েন এন্ট্রান্স পরীক্ষার রেজাল্ট এখনো প্রকাশ করা হয়নি। এই জয়েন এন্ট্রান্স রেজাল্ট প্রকাশ নিয়েই চলছে বিতর্ক। কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে— রাজ্যে শুধুমাত্র ২০০৯ সালের ওবিসি তালিকা কার্যকর হবে এবং পরবর্তীকালে যে ১৪৪ টি সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেগুলি আপাতত কোন সুযোগ সুবিধা পাবে না। এছাড়াও বলা হয়েছে রাজ্যের যে ৬৬টি সম্প্রদায় ২০০৯ সালে অন্তর্ভুক্ত ছিল তারা শুধুমাত্র ৭% সংরক্ষণের আওতায় থাকবে। বর্তমান বিভিন্ন ধরনের  সরকারি চাকরি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ভর্তি প্রক্রিয়ায় অবিলম্বে এই রায় কার্যকর হবে। এছাড়াও বলা হয়েছে আপাতত জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফল প্রকাশ স্থগিত রাখতে হবে এবং ১৫ দিনের মধ্যে নতুন করে ফল প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এই রায়ের প্রভাব

কলকাতা হাইকোর্টের এই রায় তাৎক্ষণিকভাবে সমগ্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে চাকরি-বাকরি সবক্ষেত্রেই ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। এই রায়ের ফলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে—

  1. জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা (WBJEE) – যেখানে নতুন করে তালিকা প্রকাশ করে ফল প্রকাশের কথা বলা হয়েছে এখানে নতুন সম্প্রদায় গুলোকে পুরোপুরি ভাবে বাদ দেওয়া হবে কারণ ২০০৯ সালের তালিকা মেনে ফল প্রকাশ করতে হবে তাই অনেকে এই সংরক্ষণ নীতি থেকে বঞ্চিত হবে।
  2. স্কুল সার্ভিস কমিশন (SSC) – সামনেই কিছুদিন পরে রয়েছে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা যেখানে অনেকে আশা করে বসে রয়েছেন ওবিসি সংরক্ষণ পাওয়ার জন্য তবে এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পুরনো তালিকা কার্যকর হবে।
  3. কলেজ ভর্তি ও বিশ্ববিদ্যালয় – ওবিসি কোটার সিট পুনর্বিন্যাস করা হবে। এর ফলে শুধুমাত্র নতুন সম্প্রদায় ভুক্ত জাতিগুলো এই ওবিসি সংরক্ষণ থেকে বাদ যাবে এবং পুরনো যারা ছিলেন অর্থাৎ ২০০৯ এর তালিকাভুক্ত সকলে এই সংরক্ষণের চান্স পাবে।

এই রায়ের প্রতিক্রিয়া

ইতিমধ্যেই শাসক দলের তরফ থেকে বলা হয়েছে তারা এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাবে এবং সংরক্ষণ নীতি যাতে সঠিকভাবে পুনর্বিবেচনা হয় এবং এই সংরক্ষণ যাতে সকল সম্প্রদায় সঠিকভাবে পায় (পুরনো এবং নতুন) এদিকে বিচার বিবেচনা করার কথা বলা হবে। এর পাশাপাশি আবারবিরোধী দল দাবি করছে, এই রায় প্রমাণ করেছে যে সরকার সংরক্ষণ নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করেছিল। তাই রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য সরকার নতুন এই সম্প্রদায় গুলোকে যুক্ত করেছে।

সুপ্রিম কোর্টে মামলার ভবিষ্যৎ

মামলাটি এখন সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। এখনো এই মামলায় কি হবে বলা যায় না তবে সোমবার শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। এরপরে যদি সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে, তবে এটি দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হবে। আর যদি স্থগিত রাখে, তবে বর্তমান সংরক্ষণ নীতি চালু থাকবে। এখন আমাদের দেখার বিষয় সুপ্রিম কোর্টের রায় কোন দিকে যায়।

সাধারণ মানুষের জন্য প্রভাব

হাইকোর্টের এই নতুন রায়ে সাধারণ মানুষের উপর ভীষণভাবে প্রভাব পড়বে বিশেষ করে ছাত্রছাত্রী এবং চাকরিপ্রার্থীদের উপর। অনেক ছাত্র-ছাত্রী যারা ওবিসি সংরক্ষণ নীতিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতেন তারা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন এবং অনেকে চাকরি থেকেও বঞ্চিত হবেন। তবে ইতিমধ্যে যারা নতুন তালিকায় চাকরি বা ভর্তি পেয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে কি হবে সে ব্যাপারে এখনো নতুন করে স্পষ্ট কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে এই রায়ের ফলে পুরনো তালিকা সম্প্রদায় ভুক্তদের জন্য সুযোগ অনেকটা বেড়ে যাবে এবং নতুন তালিকাভুক্ত সম্প্রদায় গুলোর সুযোগ কমে গেল।

২০০৯ বনাম নতুন তালিকা

বছরমোট সম্প্রদায় সংখ্যাবিভাগসংরক্ষণের শতাংশবর্তমান অবস্থা
২০০৯৬৬একক বিভাগ৭%বহাল
২০১০–২০১২১৪০ (OBC-A + OBC-B)দুটি বিভাগ১৭% পর্যন্তস্থগিত

FAQ

Q1: এখন কি সব ওবিসি ছাত্রছাত্রী সংরক্ষণ পাবেন?
না, শুধুমাত্র ২০০৯ সালের তালিকায় থাকা ৬৬টি সম্প্রদায়ের সদস্যরা পাবেন। বাকি ১৪৪ টি সম্প্রদায় এই রায়ে সংরক্ষণ নীতি থেকে বঞ্চিত হবে।

Q2: আগে যাঁরা নতুন তালিকায় সুবিধা পেয়েছেন, তাঁদের কী হবে?
এ বিষয়ে আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশ এখনও আসেনি, তবে সম্ভাবনা আছে ইতিমধ্যেই পাওয়া সুযোগ বাতিল হবে না। অর্থাৎ ইতিমধ্যে যারা চাকরিতে বা স্কুল কলেজে ভর্তি হয়েছেন তারা চাকরির বহাল রাখতে পারবে বা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে।

Q3: এই রায় কি স্থায়ী?
না, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর পরিস্থিতি বদলাতে পারে। এখন আমাদের দেখতে হবে সুপ্রিম কোর্টের রায় কি আছে এবং সেই রায়ের উপরেই এর স্থায়িত্ব নির্ভর করবে।

অবশেষে বলা যায় নতুন করে আবার কলকাতা হাইকোর্টের এই রায় পশ্চিমবঙ্গের সংরক্ষণ নীতিতে বড়সড় পরিবর্তন এনেছে। যারা পুরনো সম্প্রদায় ভুক্ত ছিল তাদের জন্য এটি যেমন আশীর্বাদ কিন্তু যারা নতুন সম্প্রদায় ভুক্ত তাদের জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা। এখন রাজ্যের চোখ সুপ্রিম কোর্টের দিকে, যেখানে এই ঐতিহাসিক মামলার চূড়ান্ত রায় নির্ধারণ করবে পশ্চিমবঙ্গের ওবিসি সংরক্ষণের ভবিষ্যৎ।