ভারতবর্ষের সাড়া সমস্ত দেশেই সিনিয়র সিটিজেনশিপদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। এবার অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারতবর্ষেও সিনিয়র সিটিজেনশিপ কার্ড চালু করা হলো। এর মাধ্যমে একাধিক সুযোগ-সুবিধা এবং বিভিন্ন প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা সরাসরি দেওয়া হবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি পরিষেবা, স্বাস্থ্যসেবা বা দৈনন্দিন কাজকর্মে প্রবীণদের (Senior Citizens) নানা বাধার মুখে পড়তে হয়, বিশেষ করে দেখা যায় ভারতবর্ষে সমস্ত কাজের জন্য—লম্বা লাইন, বারবার নথি দেখানো, অফিসে ঘুরে বেড়ানো, ভিড়ভাট্টায় ঠেলেঠেলে কাজ করা বরাবরই চোখে পড়ে—সব মিলিয়ে ঝক্কি কম নয়। তবে এবার এলো এক বিশাল পরিবর্তন। এই বাস্তবতাকেই বদলাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘সিনিয়র সিটিজেন কার্ড’ চালু করেছে। এর ফলে উপকৃত হবেন ভারতের প্রায় লক্ষ লক্ষ মানুষজন। এই পরিচয়পত্র বানালে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে ভারতবর্ষে, যার মাধ্যমে স্বাস্থ্য, পরিবহণ, ব্যাংকিং, কর-সুবিধা, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প—সব ক্ষেত্রেই প্রবীণরা অগ্রাধিকার ও বিশেষ সুবিধা পাবেন। এর পিছনে ভারত সরকার তথা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্দেশ্য একটাই: সম্মানজনক, নিরাপদ এবং স্বনির্ভর জীবনযাপন নিশ্চিত করা। এই উদ্যোগ সকলের জন্যই বিশেষ সুযোগ-সুবিধা এনে দিবে। তাই আপনি যদি পশ্চিমবঙ্গের একজন নাগরিক হয়ে থাকেন তাহলে এ ব্যাপারে আপনারও বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া দরকার।

যোগ্যতা (Eligibility): কারা আবেদন করতে পারবেন

  • স্থায়ী বাসিন্দা: এখানে আবেদন করতে হলে একজন ভারতবাসী হতে হবে এবং আবেদনকারীকে পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।
  • বয়সসীমা: এখানে আবেদন জানাতে হলে আবেদনকারীর বয়স হতে হবে ন্যূনতম ৬০ বছর (যার বেশি হলে বিশেষ অগ্রাধিকার)।
  • বিশেষ অগ্রাধিকার: শারীরিকভাবে অসুস্থ/নির্ভরশীল প্রবীণেরা প্রয়োজন অনুযায়ী অতিরিক্ত অগ্রাধিকার পেতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে ৬০ বছরের বেশি বয়স হলে সকলেই অগ্রাধিকার পাবেন।

এখানে আবেদন করতে লাগবে যে সব নথি (Documents)

এখানে আবেদন করতে হলে আপনার কাছে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস থাকতে হবে। আবেদনের সময় সাধারণত যে নথিগুলি চাওয়া হয়—

  • জন্মতারিখের প্রমাণ: এখানে আবেদন করার জন্য অবশ্যই থাকতে হবে জন্মসনদ/ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেট/বৈধ সরকারি নথি যেটি আপনার জন্ম তারিখ প্রমাণ করে।
  • ঠিকানার প্রমাণ: স্থায়ী বাসিন্দার প্রমাণপত্র হিসেবে আপনার কাছে অবশ্যই ভোটার কার্ড/রেশন কার্ড/বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদি যেকোনো একটি তথ্য থাকতে হবে।
  • ফটো আইডি: আইডেন্টিফিকেশন প্রমাণের জন্য আপনার অবশ্যই ভোটার আইডি/প্যান/আধার (পরিচয় যাচাইয়ের জন্য) থাকতে হবে।
  • পাসপোর্ট সাইজ ছবি: সাম্প্রতিক পাসপোর্ট সাইজের তোলা ছবি প্রয়োজন।
  • স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত নথি (যদি প্রয়োজন হয়): দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা বা প্রতিবন্ধকতার রিপোর্ট/সার্টিফিকেট যদি থাকে তাহলে দেবেন। আর যদি না থাকে তাহলে কোন চিন্তা নেই সকলেই আবেদন করতে পারবেন।

তবে এক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনে রাখবেন আপনি যে সমস্ত ডকুমেন্ট জমা দেবেন সেগুলো মূল নথির self-attested ফটোকপি জমা দেবেন, সঙ্গে অরিজিনাল কাগজ সঙ্গে রাখবেন। এক্ষেত্রে আপনি বিশেষভাবে আপনার সমস্ত তথ্য ভালোভাবে যাচাই করে দেখে নেবেন যাতে কোন ভুলত্রুটি না থাকে।

সিনিয়র সিটিজেন কার্ড ২০২৫ হল রাজ্য-স্বীকৃত পরিচয়পত্র, যা দেখালে সংশ্লিষ্ট দপ্তর/প্রতিষ্ঠান বুঝে নেবে—আপনি প্রবীণ নাগরিক এবং তালিকাভুক্ত। এর ফলে যাবতীয় কাজকর্ম করতে আপনার সুবিধা হবে এবং খুব সহজেই আপনি সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যাবেন।

স্বাস্থ্যসেবা: দ্রুত, ছাড় ও অগ্রাধিকার

প্রবীনদের স্বাস্থ্য সেবা থেকে শুরু করে সমস্ত ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দেওয়া হবে এর ফলে তারা প্রবীণদের—দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে যাবে। এছাড়াও যারা এই কার্ড বানাবেন তারা আরও যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পাবেন —

  • সরকারি হাসপাতাল/হেলথ সেন্টারে প্রায়োরিটি সার্ভিস—রেজিস্ট্রেশন, OPD, ডায়াগনস্টিক প্রক্রিয়ায় অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এর ফলে খুব দ্রুত আপনারা সঙ্গে সঙ্গে পরিষেবা পেয়ে যাবেন।
  • বিনামূল্যে/রেয়াতে নিয়মিত চেক-আপ সুবিধা পেয়ে যাবেন এর ফলে যেখানে চালু আছে, সেখানকার নিয়ম অনুযায়ী আপনারা খোঁজখবর নিয়ে এই পরিষেবা গ্রহণ করতে পারবেন।
  • জরুরি চিকিৎসায় অগ্রাধিকার—এই কার্ড থাকলে আপনার চিকিৎসা সবার প্রথমে করা হবে এবং দ্রুত আপনি পরিষেবা পেয়ে যাবেন।
  • ওষুধে আংশিক ছাড় আপনার অসুস্থ কালে যে সমস্ত ওষুধের প্রয়োজন হবে সেগুলোর উপর আপনি অনেকাংশে ছাড় পেয়ে যাবেন।
  • অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবায় বিশেষ সুবিধা— এই কার্ড থাকলে আপনি যেকোনো সময়ে অ্যাম্বুলেন্সের বিশেষ সুবিধা পেয়ে যাবেন এবং খুব দ্রুত পেয়ে যাবেন।
  • এছাড়াও বিভিন্ন হাসপাতালে প্রবীণ নাগরিকদের জন্য বিশেষ পরিষেবা চালু করা হবে যেখানে শুধুমাত্র কোভিদ নাগরিকরা খুব দ্রুত সুযোগ-সুবিধা পাবেন।

পরিবহণ: চলাচলে সহজতা, খরচে স্বস্তি

যাতায়াতের খরচ ও ভিড়—দুটোই প্রবীণদের চ্যালেঞ্জ। কার্ডের মাধ্যমে—

পরিবহনের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দেওয়া হবে এবং প্রবীণ নাগরিকদের জন্য আলাদা করে সিট সংরক্ষণ করা থাকবে এছাড়াও রেলওয়ে ভ্রমণকলে প্রবীণ নাগরিকদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। অনেকাংশে প্রবীণ নাগরিকদের যাতায়াতের ভাড়া ফ্রি করে দেওয়া হবে।

এছাড়াও প্রবীণ নাগরিকদের আরো বিশেষ ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে বিশেষ করে ব্যাংকে টাকা রাখলে বা ফিক্স ডিপোজিট করলে বা পোস্ট অফিসে টাকা রাখলে সেখানে অতিরিক্ত পরিমাণে সুদ দেওয়া হবে সাধারণ নাগরিকদের তুলনায় অনেকাংশে বেশি। এছাড়াও প্রবীণ নাগরিকদের কর ছাড় দেওয়া হবে।

সরকারি প্রকল্পে অগ্রাধিকার: এক কার্ডে বহু সুযোগ সুবিধা

সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে রাজ্য-নির্দেশিত বিভিন্ন প্রকল্পে কার্ডধারীরা অগ্রাধিকার পেতে পারেন—

  • স্বাস্থ্যসাথী-এর মতো বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত দ্রুত সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে এবং বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা পাওয়া যাবে।
  • বার্ধক্য ভাতা (Old-age Pension) সহজে পাওয়া যাবে—অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেকের ৬০ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও বৃদ্ধ ভাতা পায়ন। এই কাজ থাকলে আর কোন সমস্যা হবে না এর ফলেযাচাই ও অনুমোদনে সহায়তা হবে।
  • কৃষক বন্ধু/বিধবা ভাতা/প্রতিবন্ধী ভাতা— প্রবীণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে সমস্ত ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা খুব দ্রুত এবং আলাদাভাবে বিবেচনার মাধ্যমে সম্পূর্ণ করা হবে।
  • বৃদ্ধাশ্রম/ডে-কেয়ার সেন্টার—এই কার্ড থাকলে পরবর্তীকালে এই ধরনের সুযোগ সুবিধা খুব সহজেই পাওয়া যাবে।

সরকারের তরফ থেকে সকলকেই এই কার্ড দেওয়া হবে ফলে এই কার্ড বানাতে পারলে আপনার আর কোন চিন্তা থাকবে না সমস্ত ধরনের সুযোগ সুবিধা আপনি খুব সহজেই পেয়ে যাবেন।

আবেদন পদ্ধতি

এই কার্ডের জন্য আবেদন করতে হলে আপনাকে অবশ্যই অফলাইনের মাধ্যমে আবেদন জানাতে হবে। তবে পরবর্তীকালে অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হতে পারে। এখন যদি কেউ এই কার্ড বানাতে চাই তাহলে তাকে অফলাইনের মাধ্যমে ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে বানাতে হবে। নিচে আবেদন পদ্ধতি স্টেপ বাই স্টেপ উল্লেখ করা হলো-

  1. ফর্ম সংগ্রহ: এখানে আবেদনের জন্য প্রথমেই নিকটস্থ ব্লক অফিস/তহশিল অফিস/প্রাসঙ্গিক সরকারি ক্যাম্প থেকে আবেদনপত্র নিন।
  2. ফর্ম পূরণ: এরপর আবেদন পত্রটি নির্ভুলভাবে এবং সম্পূর্ণ সঠিক তথ্য দিয়ে পূরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোন ভুল তথ্য দেওয়া হলে বা ডকুমেন্টস এর সঙ্গে কোন তথ্যের মিল না হলে আবেদন পত্রটি বাতিল হয়ে যেতে পারে।
  3. প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সংযুক্ত করুন: এখানে আবেদন করার জন্য বেশ কিছু প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস যেমন জন্মতারিখ, ঠিকানা, ফটো আইডি, ছবি—self-attested কপি দিন; প্রয়োজনে মূল কাগজ দেখান।
  4. এরপর প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য নিয়ে আবেদন পত্রটি জমা করুন।
  5. এরপর আপনার সমস্ত তথ্য ভালোভাবে যাচাই করা হবে এবং সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আপনাকে ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে এই কার্ড দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে এই কার্ডটি আপনার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

এক্ষেত্রে আবেদন করার আগে আপনার প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্যগলো রেডি করে রাখুন এবং যদি কোন তথ্যে ভুল থেকে থাকে তাহলে সেটি ঠিক করে নিন। এক্ষেত্রে আপনার মোবাইল নাম্বারটি একটিভ রাখুন এবং সাম্প্রতিক পাসপোর্ট সাইজের ফটো তুলে রাখুন। নাম ঠিকানা বানান সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে লিখবেন এবং বিশেষভাবে মনে রাখবেন কোন দালালের চক্রে পড়ে অযথা টাকা খরচ করবেন না এটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সরকার আপনাকে দেবে।

এই একটি কার্ড বানালে আপনি বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন এবং সমাজে মর্যাদা পাবেন। এই কার্ড থাকলে আপনি ব্যাংক থেকে শুরু করে হাসপাতাল এবং পরিবহন থেকে শুরু করে কর ছাড় সমস্ত ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যাবেন।

সিনিয়র সিটিজেন কার্ড পশ্চিমবঙ্গের প্রবীণ নাগরিকদের জীবনে বড় পরিবর্তন আনতে চলেছে। এই কার্ড হাতে থাকলে হাসপাতাল, বাসস্ট্যান্ড, ব্যাংক, ব্লক অফিস—সব জায়গায় কাজের গতি বাড়ে, সম্মানের সাথে পরিষেবা মেলে। এর ফলে একটি কার্ড দিয়ে সমস্ত ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যাবেন তাই এখন যাঁরা যোগ্য—অবিলম্বে আবেদন করুন। যাঁরা অভিভাবক/পরিবার—বাবা-মা/ঠাকুমা-দাদুকে ফর্ম পূরণে সাহায্য করুন। আর দপ্তর/প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অনুরোধ—এই উদ্যোগকে গ্রাউন্ড লেভেলে কার্যকর করতে প্রবীণবান্ধব ব্যবস্থা আরও বাড়ান।