ভারতের প্রতিটি নাগরিকের জন্য আধার কার্ড এখন শুধু একটি পরিচয়পত্র নয়, বরং এক ধরনের ডিজিটাল আইডেন্টিটি। যে কোন কাজকর্মে আধার কার্ড অপরিহার্য এবং এটি ব্যবহার করা হয় সর্বক্ষেত্রে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, লোন নেওয়া, ভোটার কার্ড সংশোধন, স্কুলে ভর্তি, পেনশন, গ্যাস ভর্তুকি, এমনকি একটি মোবাইল সিমকার্ড কেনার ক্ষেত্রেও আধার অপরিহার্য। তাই ভারতের প্রত্যেকটি নাগরিকের আধার কার্ড থাকা বাধ্যতামূলক। আধারের মধ্যে রয়েছে নাগরিকের বায়োমেট্রিক তথ্য (Biometric Data) ও ব্যক্তিগত তথ্য, যা এক ক্লিকেই যাচাই করা সম্ভব। তবে এই সুবিধাই হয়ে উঠছে সবচেয়ে বড় বিপদ, কারণ প্রতারকরা এই তথ্যের অপব্যবহার করে ঘটাচ্ছে ভয়ঙ্কর জালিয়াতি। অনেকের আধার কার্ডে একাধিক সিম কার্ড তুলে প্রতারকেরা বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা করছে সাধারন মানুষের সঙ্গে। আর আপনার নামে যদি কোন সিম থাকে এবং সেই সিম দিয়ে যদি কোন প্রতারণা করা হয় তাহলে আপনার জেল পর্যন্ত হতে পারে। তাহলে কিভাবে আপনি এই জালিয়াতি থেকে রক্ষা পাবেন এবং কিভাবে চেক করে দেখে নিতে পারবেন আপনার আধার কার্ডে কতগুলো সিম কার্ড রয়েছে। যদি আপনার আধার কার্ডে অবৈধভাবে একাধিক সিম কার্ড থাকে তাহলে আপনি সেটি বন্ধ করে পড়াশোনা দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারেন। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা সে ব্যাপারেই বিস্তারিতভাবে জেনে নেব।

Aadhaar Fraud Alert 2025
Aadhaar Fraud Alert 2025

আধারের ব্যবহার বাধ্যতামূলক যেসব ক্ষেত্রে

আজকের দিনে আধার ছাড়া প্রায় কোনও সরকারি বা বেসরকারি কাজ করা সম্ভব নয়। যেমন:

  • ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা বা ক্রেডিট কার্ড/লোন প্রসেসিং আধার কার্ড ছাড়া অসম্ভব।
  • বর্তমান দিনে নতুন মোবাইল সিমকার্ড ইস্যু আধার কার্ড ছাড়া হয় না
  • ভোটার কার্ড ও প্যান কার্ড আপডেট করতে গেলেও আধার কার্ড প্রয়োজন।
  • গ্যাস ভর্তুকি, পেনশন বা সরকারি ভাতা গ্রহণ আধার কার্ড দরকার।
  • পাসপোর্ট বা ভিসা আবেদন করার জন্য আধার কার্ড প্রয়োজন।
  • স্কুল-কলেজ ভর্তি ও পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করার জন্য আধার কার্ড বাধ্যতামূলক।

এই কারণে আধার এখন নাগরিক জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। কিন্তু ঠিক এই কারণেই এটি হয়ে উঠছে প্রতারণার সহজ অস্ত্র। কারণ মানুষ সর্ব ক্ষেত্রে আধার কার্ড ব্যবহার করে আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রত্যেকের আধার কার্ড প্রতারকরা খুব সহজেই পেয়ে যেতে পারে।

আধার জালিয়াতির সাম্প্রতিক প্রবণতা

আধার জালিয়াতি এখন ভারতের সবচেয়ে আলোচিত সমস্যাগুলির মধ্যে একটি। প্রতারকরা আধারের তথ্য ব্যবহার করে নানা ধরনের অপরাধ করছে—

  1. ব্যাংক জালিয়াতি: আধারের কপি ব্যবহার করে ভুয়ো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে। এর ফলে বিভিন্ন অবৈধ কাজ করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন অবৈধভাবে ব্যাংক একাউন্টে টাকা ঢোকানো হচ্ছে যেটি পুরোপুরি জালিয়াতি এবং এরকম হলে আপনাকে জেলে যেতে হতে পারে। তাই আজই সতর্ক হয়ে তাড়াতাড়ি চেক করে দেখে নিন আপনার আধার কার্ডে কোন ভুয়ো একাউন্ট খোলা রয়েছে কিনা।
  2. সিমকার্ড জালিয়াতি: নাগরিকের অজান্তেই আধার দিয়ে সিমকার্ড ইস্যু হচ্ছে। অনেকের আধার কার্ড এবং অবৈধভাবে বায়োমেট্রিক নিয়ে তাদের নামে সিম কার্ড খুলে অবৈধ কাজ কর্ম করা হচ্ছে। তাই কোথাও আধার কার্ড বা বায়োমেট্রিক দেওয়ার আগে ভালোভাবে যাচাই করে তারপরে দেবেন।
  3. KYC জালিয়াতি: ভুয়ো কেওয়াইসি করে লোন বা ক্রেডিট কার্ড নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে আপনার আধার কার্ড নাম্বার এবং ওটিপি যাওয়া হচ্ছে যেটি পুরোপুরি অবহিত এবং এর মাধ্যমেও জালিয়াতি করা হচ্ছে।
  4. ডিজিটাল পরিচয় চুরি: আধারের তথ্য ব্যবহার করে সাইবার অপরাধ করা হচ্ছে।

সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন সিনিয়র সিটিজেনরা, কারণ তাঁদের তথ্য সহজেই প্রতারকদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে।

সিমকার্ড জালিয়াতি কীভাবে হয়?

মোবাইল সিমকার্ড কেনার সময় আমরা সাধারণত আধারের ফটোকপি দিই বা বায়োমেট্রিক যাচাই করি। এখানেই তৈরি হয় জালিয়াতির সুযোগ। আপনি একটি সিম কার্ডের জন্য বায়োমেট্রিক দিয়ে থাকেন কিন্তু দেখা গেল অবৈধভাবে আপনার নামে একাধিক সিম কার্ড ইস্যু করা হলো এর ফলেই শুরু হয় অবৈধ ক্রিয়াকলাপ এবং জালিয়াতি।

  • অনেক অসাধু দোকানদার বা ব্যবসায়ী আধারের কপি বিক্রি করে দেয় চক্রের কাছে
  • আপনার আধার ব্যবহার করে অজানা ব্যক্তির নামে একাধিক সিমকার্ড চালু হয়
  • সেই সিম যদি অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত হয়, দায় এসে পড়ে আপনার ওপর।
  • এর ফলে আইনগত হেনস্থা, এমনকি পুলিশের গ্রেফতার পর্যন্ত হতে পারে।

এই সমস্ত জালিয়াতি এবং দুর্নীতির থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আপনাকে আগে থেকেই সতর্ক হতে হবে না হলে পরবর্তীকালে বিপদে পড়তে পারেন।

আধার জালিয়াতির ঝুঁকি

  1. আইনগত ঝুঁকি: অপরাধমূলক কাজে আপনার নামে ইস্যু হওয়া সিম ব্যবহৃত হলে আইনি জটিলতায় পড়বেন আপনি। এর ফলে আপনার জেল হয়ে যেতে পারে।
  2. আর্থিক ঝুঁকি: ভুয়ো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, লোন বা অনলাইন ট্রান্সঅ্যাকশনের মাধ্যমে টাকা হারানোর আশঙ্কা থাকে। এর ফলে আপনার ব্যাংক একাউন্টের টাকাও কেটে নিতে পারে।
  3. ব্যক্তিগত ঝুঁকি: ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়ে পরিচয় চুরির শিকার হতে পারেন। এর ফলেও আপনি হেনস্থার শিকার হতে পারেন পুলিশের দ্বারা।

কীভাবে জানবেন আপনার নামে কত সিমকার্ড আছে? (TAFCOP Process)

সরকার এ ধরনের জালিয়াতি রোধে চালু করেছে TAFCOP Portal। এর মাধ্যমে আপনি সহজেই জানতে পারবেন আপনার আধার দিয়ে কত সিমকার্ড ইস্যু হয়েছে। আপনার নামে যদি একাধিক সিম কার্ড ইস্যু করা থাকে তাহলে আপনি সেটাকে বন্ধ করে দিতে পারবেন এবং বড় কোন জালিয়াতের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারেন।

👉 প্রক্রিয়া:

  1. সবার প্রথমেই মোবাইল ব্রাউজারে যান https://tafcop.sancharsaathi.gov.in
  2. হোমপেজে “Know Mobile Connections in Your Name”-এ ক্লিক করুন।
  3. আর এখান থেকে আপনার আধার-লিঙ্কড মোবাইল নম্বর লিখুন এবং ক্যাপচা দিন।
  4. আপনার মোবাইলে OTP আসবে, সেটি দিয়ে লগইন করুন। এরপরেই আপনি দেখতে পারবেন আপনার সমস্ত তথ্য।
  5. এখানে স্ক্রিনে দেখবেন আপনার নামে কত সিমকার্ড অ্যাকটিভ আছে। এখান থেকে দেখুন এবং আপনার যদি কোন sim card একটিভ থাকে যেটা আপনি ইউজ করেন না তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা বন্ধ করে দেন।
  6. অচেনা নম্বর দেখলে সঙ্গে সঙ্গে Report করুন।

কীভাবে প্রতিরোধ করবেন আধার জালিয়াতি?

বিভিন্নভাবে অবৈধ জালিয়াতি এবং আধার জালিয়াতীয় রোধ করা যায় এর জন্য আধারের ফটোকপি যেখানে সেখানে দেবেন না। যদি কপি দিতেই হয়, তবে Date ও Purpose লিখে দিন। সরকারি কাজ ছাড়া কোথাও বায়োমেট্রিক শেয়ার করবেন না। এই বায়োমেট্রিক ব্যবহার করেই বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতি করতে পারে প্রতারকেরা। নিয়মিত TAFCOP পোর্টালে চেক করুন।
আপনার আধারের সঙ্গে যুক্ত মোবাইল নম্বর ও ইমেইল সবসময় আপডেট রাখুন। কোন অবৈধ ক্রিয়াকালাপ হলে আপনি সে ব্যাপারে সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট করুন।

আধার আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। যেকোনো কাজকর্ম করতে গেলে আধার কার্ড প্রয়োজন হয়। তবে এর অপব্যবহার ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আধার কার্ড জালিয়াতি বর্তমান ভারতের সর্ববৃহৎ জালিয়াতির মধ্যে চলে এসেছে। আপনার অজান্তেই আপনাকে ফাঁসানো হবে বিভিন্নভাবে এই আধার জালিয়াতির মাধ্যমে। তাই এখন থেকেই সতর্ক হোন, নিয়মিত নিজের নামে কত সিমকার্ড চলছে তা চেক করুন এবং সন্দেহজনক কার্যকলাপ সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট করুন। আধার ব্যবহার করুন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে—কারণ একটিমাত্র অসতর্কতা আপনার জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে।