ভোটার তালিকা একটি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাণভিত্তি। অবশেষে পশ্চিমবঙ্গের শুরু হতে যাচ্ছে এই ভোটার তালিকা সংশোধন অর্থাৎ SIR। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ চিন্তিত। কিন্তু এই সংশোধনের কথা শুনে কেন সবাই ভয় পাচ্ছে? কি কি ডকুমেন্টস না থাকলে আপনার নাম বাদ চলে যেতে পারে? সম্প্রতি বিহারে শুরু হয়েছে বিশেষ নিবিড় সমীক্ষা (Special Intensive Revision – SIR), যা নিয়ে দেশজুড়ে রাজনৈতিক বিতর্ক তুঙ্গে। তবে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হলে কি করলে আপনার নাম থাকবে এবং কেন আধার কার্ড ভোটার কার্ড বা রেশন কার্ড গ্রহণযোগ্য হবে না চলুন এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জেনে নেওয়া যাক।

অনেকেই এই সংশোধনের কথা শুনে ভয় পাচ্ছেন কারণ বিহারে ৬০ লক্ষ মানুষের নাম বাদ চলে গিয়েছে ভোটার তালিকার সংশোধনের ফলে। পশ্চিমবঙ্গেও বেশিরভাগ মানুষ এই সংশোধনের কথা শুনে আতঙ্কে রয়েছেন। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ হল বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকা তাই বহু মানুষ বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসে অবৈধভাবে ভোটার কার্ড বা আধার কার্ড বানিয়ে রেখেছেন। এই সমস্ত সমীক্ষা করা হবে। তবে চিন্তা নেই কি করলে আপনার নাম ভোটার তালিকায় থেকে যাবে সে ব্যাপারে আজকের এই প্রতিবেদনে বিস্তারিত জেনে নেব।
নিবিড় সমীক্ষা (SIR) কী?
নির্বাচন কমিশনের ভাষায়, বিশেষ নিবিড় সমীক্ষা হলো ভোটার তালিকার এক ধরনের পুনঃনিরীক্ষণ প্রক্রিয়া। পশ্চিমবঙ্গের শেষবারের জন্য ২০০২ সালে এই সমীক্ষা হয়েছিল এবং 2025 সালে আবারো নতুন করে এই সমীক্ষা হবে। নির্বাচন কমিশন বলেছে ২০২৬ এ রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন এবং এই নির্বাচনের আগেই এই সমীক্ষা সম্পন্ন করতে হবে এবং নতুন করে ভোটার তালিকা প্রকাশ করতে হবে। প্রধানত এই সমীক্ষা করার পিছনে মূল কারণ হলো এই প্রক্রিয়ায় খতিয়ে দেখা হয় ভোটার তালিকায় মৃত ব্যক্তি বা স্থানান্তরিত মানুষের নাম আছে কি না। ভুয়ো ভোটারের নাম থাকলে সেটিও বাদ দেওয়া হয়। নতুন ভোটাররা নথি জমা দিয়ে তালিকায় নাম তুলতে পারেন। তবে ২০০২ সালের পর থেকে অনেক নতুন ভোটাররা এই ভোটার লিস্টে যুক্ত হয়েছেন এবং তাদের পরিপূর্ণ নথি দেখাতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে সর্বশেষ দেশজুড়ে এই ধরনের নিবিড় সমীক্ষা হয়েছিল ২০০২–২০০৪ সালের মধ্যে। বিহারে তা হয়েছিল ২০০৩ সালে। এখন ২২ বছর পর ফের এই প্রক্রিয়া শুরু হলো।
কেন এত আলোচনা?
ইতিমধ্যেই বিহারে এই সমীক্ষা হয়েছে যেখানে ৫৬ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়েছে। এই ৫৬ লক্ষ মানুষের মধ্যে অনেক রয়েছে মৃত ব্যক্তি এবং অনেকেই উপযুক্ত তথ্য প্রমান দিতে পারেনি বা উপযুক্ত নথি দেখাতে পারেনি তাই তাদের নাম বাদ চলে গিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছেন, এত বড় আকারে নাম বাদ পড়া মানেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত। বিজেপি বলছে এটি ভোটার তালিকার “সাফাই অভিযান”, কংগ্রেস বলছে “গণতন্ত্রের জবাই”, তৃণমূলের দাবি “ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র”।
কোন কোন নথি চাই? (১১টি নথির তালিকা)
নির্বাচন কমিশন মোট ১১টি নথি নির্ধারণ করেছে, যেগুলির ভিত্তিতে প্রকৃত ভোটার হিসেবে নাম রাখা হবে। এই ১১ টি নথির মধ্যে যে কোন একটি নথি যদি আপনার থেকে থাকে তাহলে আপনার কোন চিন্তা নেই।
নং | প্রযোজ্য নথি | বিস্তারিত ব্যাখ্যা |
---|---|---|
১ | সরকারি কর্মচারীর পরিচয়পত্র | কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারি কর্মচারী এবং অবসরপ্রাপ্তদের জন্য প্রযোজ্য |
২ | ১ জুলাই ১৯৮৭ সালের আগের সরকারি নথি | ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, LIC-এর কাগজও গ্রাহ্য |
৩ | জন্মসনদ | জন্মের প্রমাণ হিসেবে |
৪ | বৈধ পাসপোর্ট | নাগরিকত্ব যাচাইয়ের ভিত্তি |
৫ | শিক্ষাবোর্ড/বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ | যেখানে জন্ম তারিখ উল্লেখ আছে |
৬ | স্থায়ী বসবাসের শংসাপত্র | সংশ্লিষ্ট রাজ্য/এলাকার |
৭ | তফসিলি জাতি, উপজাতি বা ওবিসি শংসাপত্র | সামাজিক শ্রেণির ভিত্তিতে |
৮ | এনআরসি তালিকায় নাম | যাদের নাম আছে |
৯ | বনাঞ্চল অধিকারের শংসাপত্র | নির্দিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের জন্য |
১০ | পারিবারিক রেজিস্টার | রাজ্য বা স্থানীয় প্রশাসনের প্রস্তুত করা |
১১ | সরকার প্রদত্ত জমি বা বাড়ির নথি | দলিল, পর্চা ইত্যাদি |
আধার, EPIC (ভোটার আইডি) বা রেশন কার্ড চলবে না কেন?
সুপ্রিম কোর্ট কমিশনকে পরামর্শ দিয়েছিল আধার, ভোটার আইডি এবং রেশন কার্ডকে বৈধ নথি হিসেবে ধরতে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন যুক্তি দিয়েছে আধার কার্ড ভোটার কার্ড বা রেশন কার্ড কোনমতেই নাগরিকত্বের প্রমাণ হতে পারেনা এগুলো শুধুমাত্র পরিচয়পত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফলে এই তিনটি জনপ্রিয় নথি গ্রহণ করা হয়নি। তবে দেখা গিয়েছে বিহারে যে সমস্ত ব্যক্তির নাম বাদ পড়ে গিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের তরফ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তারা আধার কার্ড দেখিয়ে নতুন করে ভোটার তালিকায় নাম লেখানোর জন্য আবেদন জানাতে পারবেন।
কাদের নথি জমা দিতে হবে?
এখানে মূলত যারা প্রাপ্তবয়স্ক রয়েছে তাদের কোনরকম নথি জমা করতে হবে না এবং যাদের নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় রয়েছে তাদেরও কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু এখানে সমস্যা হল ২০০২ এর পর থেকে অর্থাৎ ২০০৩ সাল থেকে যাদের নাম ভোটার লিস্টে স্থান পেয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্ত নথিগুলো যাচাই করা হবে। এবার নতুন করে এই সমস্ত নথির ভিত্তিতে ভোটার তালিকা সংশোধন হবে।
সমীক্ষার প্রক্রিয়া
এই সমীক্ষা করা হবে বুথ অনুযায়ী। প্রতিটি বুথে একজন বুথ লেভেল অফিসার (BLO) থাকবেন। BLO বানানো হবে কোন সরকারি অফিসার অথবা শিক্ষকদের। সমীক্ষা করার সময় আপনার উপযুক্ত নথি ও ভোটারদের নথি জমা দিতে হবে BLO-র কাছে। প্রথম পর্যায়ে বুথভিত্তিক সমীক্ষা শেষ হওয়ার পরে তা বিধানসভা, তারপর জেলা, শেষে মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের কাছে পাঠানো হবে।অবশেষে চূড়ান্ত তালিকা তৈরি হবে। আপনার সমস্ত নথি এবং তথ্য প্রমান ঠিক থাকলে নতুন যে লিস্ট তৈরি হবে সেখানে আপনার নাম অবশ্যই থাকবে। তবে আপনি যদি কোন ভুল তথ্য দিয়ে থাকেন তাহলে আপনার নাম বাদ পড়ে যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে বিভ্রান্ত, কোন নথি গ্রাহ্য হবে আর কোনটা নয় তা বুঝতে পারছেন না। এক্ষেত্রে যদি আপনার নাম্বার চলে যায় তাহলে পরবর্তীকালে আপনি আধার কার্ড ও অন্যান্য ডকুমেন্টস দেখিয়ে আবেদন জানাতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে শুধুমাত্র আধার কার্ড কে গ্রহণযোগ্য করা হবে না এর সঙ্গে আরও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট জমা করতে হবে।
ভোটার তালিকা একটি গণতান্ত্রিক দেশের মূল স্তম্ভ। তাই এই ভোটার তালিকা স্বচ্ছ করা প্রয়োজন। তালিকা নির্ভুল করা জরুরি, যাতে মৃত বা ভুয়ো ভোটার থেকে যায় না। তবে সেই প্রক্রিয়া যেন সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত না করে, বরং সহজ ও স্বচ্ছ হয়। তবে এখানে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তির কোন কারণ নেই এটি মূলত করা হচ্ছে জনসাধারণের ভালোর জন্য এবং দেশের জনগণের উন্নতির স্বার্থে।

My name is Sujit Roy, and I have been involved in content writing for the past four years. I provide various types of informative content for users.