বর্তমান সময়ে পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণের মধ্যে একটা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে নাগরিকত্ব প্রমাণ নিয়ে এছাড়াও মানুষের মনে প্রশ্ন জাগছে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য কোন কোন নথি বৈধ। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকা সমীক্ষা হবে যেখানে 2002 সালের ভোটার তালিকায় নাম থাকতে হবে। ভারতের রাজনৈতিক এবং সামাজিক দুই প্রেক্ষাপটেই নাগরিকত্বের প্রমাণ বিষয়টি নতুন নয় তবে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে ভোটার তালিকা সংশোধন হতে যাচ্ছে তাই সকলের মনে গভীর প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে ঘোষণা হয়ে গিয়েছে ২০২৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি অসম, কেরালা, তামিলনাড়ু এবং পুদুচেরিতে বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে। ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিহারে গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচন সামনে রেখে দেশের ভোটার তালিকায় Special Intensive Revision (SIR) কর্মসূচি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। এবার পশ্চিমবঙ্গেও শুরু হতে চলেছে এই প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় সরাসরি বাড়ি বাড়ি গিয়ে সার্ভে করবেন বিএলআরও (BLO) কর্মীরা — এছাড়াও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকার তথ্য যাচাই, নতুন ভোটারের নাম তোলা এবং ভুল সংশোধনের কাজ চলছে।
কেন নাগরিকত্ব প্রমাণ এখন জরুরি বিষয়?
ভারত সরকার এবং প্রশাসনের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সংশোধিত ভোটার তালিকায় শুধুমাত্র ভারতীয় নাগরিকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা। বিশেষ করে ভারতের পার্শ্ববর্তী রাজ্য যেমন বাংলাদেশ, মায়ানমার, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং আরো অন্যান্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে বিদেশি অনুপ্রবেশ রুখতে কড়া নজরদারি চলছে। এর মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে — আধার কার্ড, ভোটার কার্ড বা রেশন কার্ড কি নাগরিকত্বের চূড়ান্ত প্রমাণ? নাকি ভারতের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হলে প্রয়োজন অন্যান্য ডকুমেন্টসের, এই বিষয়টি এখন সকলের মনের প্রশ্ন। তবে আপনার চিন্তার কোন কারণ নেই আজকের এই প্রতিবেদনে আপনার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।
বেশিরভাগ মানুষই ভাবেন আধার কার্ড অথবা ভোটার কার্ড থাকলেই সে ভারতের নাগরিক হয়ে গেল তবে বিষয়টা এতটাও সহজ নয়। সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্টভাবে বলেছে — পরিচয়পত্র (ID) থাকলেই নাগরিকত্ব প্রমাণ হয় না। নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে গেলে শুধুমাত্র ঠিকানার নথি (আধার কার্ড ভোটার কার্ড ) বা ভর্তুকি পাওয়ার কার্ড (রেশন কার্ড) থাকলেও সেটা নাগরিকত্বের একক প্রমাণ নয়। নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য প্রয়োজন আরও বেশ কিছু নথি ও তথ্য প্রমাণের।
ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণে গ্রহণযোগ্য নথি
নির্বাচন কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী নিচের চারটি নথি নাগরিকত্ব প্রমাণে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বলে ধরা হয়।
১. জন্ম শংসাপত্র (Birth Certificate)
কারো জন্ম যদি ভারতের ভূখণ্ডে হয়ে থাকে এবং তা সরকারি বা স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানের নথিতে লিপিবদ্ধ থাকে তাহলে এটি নাগরিকত্বের সেরা প্রমাণ বলা যায়। জন্মের পর এই নথি বানাতে হয় পৌরসভা, গ্রাম পঞ্চায়েত, বা সরকারি অনুমোদিত হাসপাতাল থেকে। তাই জন্মসূত্রে সে যে ভারতীয় এটা এই নথি প্রমাণ করে। যদি কোন ব্যক্তি ভারতীয় ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করে এবং ২০০৪ সালের আগে জন্ম নেয় তাহলে সেই সমস্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে জন্ম শংসাপত্রের গুরুত্ব বেশি। যদি কারো নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ হলে আদালত ও প্রশাসন প্রথমেই এই নথি দেখতে চায়।
২. ভারতীয় পাসপোর্ট
যদি কারো কাছে বৈধ পাসপোর্ট থেকে থাকে তাহলে সেটি ভারতীয় নাগরিকত্বের একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ। কারণ ভারতীয় পাসপোর্টে স্পষ্টভাবে “Indian Citizen” লেখা থাকে, যা সরাসরি নাগরিকত্ব প্রমাণ করে। তবে এক্ষেত্রে পাসপোর্টটি অবশ্যই আপডেট থাকতে হবে এবং বৈধ হতে হবে। যদি কারো পাসপোর্ট এর মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায় তাহলে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। পাসপোর্ট ভারতীয় নাগরিকত্বের অন্যতম প্রমাণ হওয়ার পিছনে কারণ হলো এতে জন্মস্থান ও ব্যক্তিগত তথ্যও অন্তর্ভুক্ত থাকে, যা যাচাইয়ের সময় সহায়ক।
৩. জাতীয়তা শংসাপত্র (Nationality Certificate)
যদি কোন ব্যক্তি জন্ম থেকেই ভারতের বাইরে থাকে এবং পিতা-মাতা ভারতীয় হলে বা নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ থাকলে এই শংসাপত্র দেওয়া হয়। যদি কারো কাছে এই সংসার পত্র থেকে থাকে তাহলেও সেটি ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ করে। এই শংসাপত্রটি প্রদান করা হয় রাজ্য সরকার বা জেলা প্রশাসন দপ্তরের তরফ থেকে। এই ডকুমেন্টসটি সীমান্তবর্তী রাজ্য বা নাগরিকত্ব-সংক্রান্ত জটিলতায় থাকা ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ করে কার্যকর হয়।
৪. নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট / রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট
যে সমস্ত ব্যক্তি বিদেশী নাগরিক হিসেবে প্রথমে ভারতে আসে এবং পরবর্তীকালে আইনি প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব পেয়েছে তারাও ভারতের নাগরিক হিসেবেই গণ্য। এটি স্বাধীনতার পরবর্তীকালের ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন, ধারা ৫ ও ৬ অনুযায়ী বৈধ। বিশেষ করে অনেক নাগরিক বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা মায়ানমার থেকে ভারতে এসে ভারত সরকারের কাছে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছিল এবং পরবর্তীকালে নাগরিকত্ব পেয়েছিল এবং নাগরিকত্ব প্রাপ্ত শরণার্থী হলেও ভারতীয় নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত।
এরকম আরো ১১ টি নথিপত্র নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে জারি করা হয়েছে যেগুলো প্রমাণ করে ভারতীয় নাগরিকত্ব।
কেন আধার, ভোটার বা রেশন কার্ড একক প্রমাণ নয়
তবে এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে আধার কার্ড ভোটার কার্ড বা রেশন কার্ড কে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য করেনি। আধার কার্ড মূলত ভারতের পরিচয় পত্র এবং ঠিকানার প্রমাণপত্র তাই এটি কোন নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। ভোটার কার্ড ও নাগরিকত্বের প্রমাণ নয় কারণ ভোটার তালিকায় ভুলবশত বিদেশি নামও থাকতে পারে, তাই এটি একা নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে না। মূলত রেশন কার্ড দেওয়া হয় ভর্তুকি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য, তাই রেশন কার্ড কখনোই প্রমাণ করে না নাগরিকত্ব এবং নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি যুক্ত নয় রেশন কার্ড।
সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ
সুপ্রিম কোর্ট একাধিক রায়ে বলেছে শুধুমাত্র ঠিকানা প্রমাণপত্র কখনোই ভারতীয় নাগরিক প্রমাণ করে না, এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের তরফে বলা হয়েছে —
“নাগরিকত্ব নির্ধারণের জন্য শুধুমাত্র পরিচয়পত্র যথেষ্ট নয়। জন্মস্থান, পিতামাতার নাগরিকত্ব এবং আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসারে প্রমাণ দিতে হবে।”
নির্বাচন কমিশনের অবস্থান
ইতিমধ্যেই আমাদের পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধন হয়েছে এবং বিহারের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হবে। তবে এক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে অনেকের নাম বা চলে গিয়েছে সঠিক প্রমাণ পত্র দেখাতে না পারায়। এই নিয়ে তুমুল উত্তেজনা শুরু হয়েছে এবং বলা হয়েছে অবৈধ অভিবাসীর নাম তালিকায় থাকবে না। এছাড়াও যদি কেউ ভোটার হিসেবে নাম রাখতে চান তাহলে তার বৈধ নাগরিকত্ব প্রমাণ থাকা আবশ্যক।
আপনার কী করণীয়?
বৈধ নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য অবশ্যই বৈধ কাগজপত্রগুলি সংগ্রহ করে রাখুন। যদি আপনার কোন নথি হারিয়ে গিয়ে থাকে বা খুঁজে না পান তাহলে সেটি আগেভাগেই প্রশাসনকে জানান এছাড়াও যদি কোন কাগজপত্রে ভুল থেকে থাকে তাহলে সেটি সংশোধন করে নিন। এছাড়াও BLO-এর মাধ্যমে সমস্ত তথ্য ভালোভাবে যাচাই করান।
ভারতের নাগরিকত্ব প্রমাণ শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের জন্য নয় বরং এটি ভবিষ্যতের জন্য এবং এটি আপনার সংবিধানিক অধিকার ও নিরাপত্তাকে সুরক্ষিত করে।আধার, ভোটার বা রেশন কার্ডের পাশাপাশি একটি বৈধ ও সরকারি অনুমোদিত নাগরিকত্ব নথি থাকা একান্ত জরুরী। সামনেই রয়েছে নির্বাচন এবং নির্বাচনের আগে প্রস্তুতি নেওয়াটা বিশেষ জরুরী।

My name is Bongo Sambad, and I have been involved in content writing for the past four years. I provide various types of informative content for users.